Islam: Fundamental and Popular Phase- A comparative dialogue.

Share Embed


Descripción

মৌল ও লৌকিক ইসলাম- তুলনামূলক আলোচনা
-শুভপ্রতিম রায়চৌধুরী

খাগরাগড়-উত্তর এই সময়ে সন্দেহ ও অবিশ্বাস বিস্তৃত করেছে তার উপনিবেশ। প্রতিবেশকে না চিনে, প্রতিবেশীর সাথে না মিশে মন্তব্য করা হচ্ছে, প্রাচীর তোলা হচ্ছে কংক্রিটের। বার্লিনের থেকেও দুর্ভেদ্য তার ভিত। ইসলামকে একমুখী বলার মধ্যে এক না জানার মূর্খতা (?) থাকতে পারে, থাকতে পারে ষড়যন্ত্র ও শঠতার যৌথসূচি। যদিও একমুখী ইসলামের প্রকল্পে ও প্রচারে শরীয়তপন্থীদের উদ্যোগ সর্বাগ্রে। তারাই দেশ ও কাল নির্বিশেষে আঘাত হানে বহুমাত্রিক ও রঙিন ইসলামের ওপর। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে ইসলাম প্রবেশ করেছে, প্রভাবিত করেছে স্থানীয় জনগোষ্ঠী, ভাষা, সংস্কৃতি এমনকি ধর্মকেও। আবার নিজেও প্রভাবিত হয়েছে লোকজ রীতি, ভাষা-সংস্কৃতি এমনকি ধর্ম থেকেও। পারস্পরিক এই লেনদেন থেকে জন্ম নিয়েছে লৌকিক ইসলাম। লৌকিক ইসলামের উপস্থিতিকে দার্শনিক ভিত্তি দিয়েছে সুফিবাদ। একাধিক সুফিপন্থ বা তরিকা এনেছে বৈচিত্র্য, এনেছে সঙ্গীত, নৃত্য, অঙ্কন ইত্যাদির বর্ণময়তা। যা মৌল ইসলামে নিষিদ্ধ। তাই বলা যায়, লোকজ ইসলামের উপস্থিতি এক নম্র প্রতিবাদ, যা প্রকারন্তরে মৌল ইসলামকেই করেছে চ্যালেঞ্জে। তাই এই আক্রমণ বা লোকজ বিষয়গুলি প্রথমে আত্মীকরণ এবং পরে নির্মূলীকরণের শরিয়তি কর্মসূচি। ঠিক যেভাবে ভক্তি আন্দোলন(এই বাংলায় বিশেষত বৈষ্ণব ধারা)কে আত্মীকরণ করেছে ব্রাম্ভন্যবাদ। বিস্তৃত আলোচনায় ঢোকার অবকাশ নেই, এখানে কয়েকটি তথ্য রাখা হল যা মূলত বিভিন্ন সময়ে করা সমীক্ষা ও বিক্ষার সংশ্লেষ। সমাজ জীবনে বহুকাল ধরে চলে আসা সহজিয়া ও কেতাবি ধারার সম্পর্ক ও সংঘাতের এই হল কয়েকগুচ্ছ চিত্র-বাস্তবতা।
তথ্য-১
লোটফি, ইরানের 'বারান সঙ্গীত দল'-এর গায়িকা, স্থান কলকাতার এক সুফিগানের ওয়ার্কশপ। দুই চোখ তন্দ্রালসা, হাত দুটি ওপরে তোলা, নাচের ভঙ্গি, বুঁদ হয়ে দুলছে সারা শরীর। মুক্তমঞ্চে তখন গান ধরেছেন সুমি শবনম, বাংলাদেশ থেকে আসা লালন গোষ্ঠীর গায়িকা, এক হাতে একতারা-
বলি মা তোর চরণ ধরে, ননি চুরি আর করব না
আর আমারে মারিস নে মা......
সমবেত আফগান, তাজিক, সিরিয়, মিশরিয় সুফি গানের দলগুলোর তখন যেন তুরীয় অবস্থা। এক হাত ওপরে, অন্য হাত নিচে, নিজ কেন্দ্রে প্রদক্ষিণরত।মুদ্রিত চোখ, অনাবিল এক আনন্দ মুখ জুড়ে, সুরের মূর্ছনায়। লোটফি আমার অদূরে নৃত্যরতা।
গান শেষ হল, নতুন দল মঞ্চে উঠবে এবার। আড্ডা শুরু আমাদের। লোটফি বলল,গান হল প্রেমের রহস্য আর প্রেম হল ঈশ্বরের রহস্য, গান তো জীবনের অঙ্গ। আড্ডা জমে উঠল। লোটফি প্রাণখোলা। বলল, সৌন্দর্যের প্রশংসা এবং তার জন্য হৃদয়ের অনুভূতিকে উত্তেজিত করতে ধ্বনির প্রয়োজন, ধ্বনি শুধু ধ্বনি। ধ্বনিতে সৌন্দর্য ও সদিচ্ছা থাকে, তাই সুফি পন্থে সঙ্গীত আবশ্যক। কিন্তু সঙ্গীত নিয়ে শরিয়তপন্থীদের আপত্তি। পাশে বসে আফগানিস্তান থেকে আসা সুফিগায়ক মীর আফগান হামিদি। মুচকি মুচকি হাসি। হটাৎ মুখের হাসি মিলিয়ে গেল, একটু সিরিয়াস। আমি এসেছি হেরাট থেকে, তালিবান আমলে বন্ধ ছিল গান, বন্ধ ছিল সমা। কত গানের দলকে যে ওরা কতল করেছে তার কোন হিসাব নেই। ওরা আমাদের ঘর জ্বালিয়েছে, শিশুদেরও রেহাই দেয়নি। আমাদের শেষ করা যায়নি। আমরা পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি। কালো বোরখার ভিতর থেকে মায়ের কান্না হয়ে, ভোরের আযান হয়ে ফিরে এসেছে গান।
একটা কবিতা শোনালেন হামিদি, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের লেখা-
আজিজ-এ আহল-এ-সিতম কি বাত করো
ইশক কি দম-কদম কি বাত করো।
(পাষণ্ডের ভরসাহীনতার কথা বল, ভালবাসার ক্ষমতার কথা বল)

তথ্য-২
বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক শক্তিনাথ ঝা। মুর্শিদাবাদ জেলার বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে বাউল ফকিরদের নিয়ে অনেক কাজ করেছেন তিনি। প্রসঙ্গত বলা যায়, 'প্রতিবাদী বাউল ফকির সমাজ' একটি মঞ্চ, যারা বাউল ফকিরদের ওপর শরিয়তপন্থীদের আক্রমণের প্রতিবাদ করে, প্রতিরোধ করে। শক্তিনাথ ঝা এই মঞ্চের অন্যতম উদ্যোগী। এখানে বাউল-ফকিরদের ওপর তাঁর কাজের অভিজ্ঞতা থেকে আহৃত কয়েকটি তথ্য রাখা হল-
লালনের নামে প্রচলিত গানগুলিতে কোথাও নিজেকে বাউল বলেননি লালন সাঁই। লালনের শিষ্যরা গুরুকে সাঁই, দরবেশ বলতেন। 'দরবেশ' হল ফারসি শব্দ, তুর্কি ও আরবিতে এর সমার্থক শব্দ হল, শেখ, ফকির, সুফি, জাহিদ ইত্যাদি। ইসলাম সন্ন্যাস ও ভিক্ষাকে সমর্থন না করলেও সুফিবাদে এর প্রচলন আছে। সুফি নামের আড়ালে প্রতিবাদী গোষ্ঠীগুলি একত্রিত হতে থাকে। বলা হয় সুফিবাদ যদি এক দর্শন বা জীবনবোধ হয় তবে ফকিরি বা দরবেশপন্থা তথা বাউল সেই পথের ভিত্তিতে গড়া বিশেষ জীবনধারা। অপেক্ষাকৃত বেশী রক্ষণশীল সুফি সাধকেরা তুলনায় কম আচার মানেন। এমন সাধকদের বে শরা বা অবৈদিক বা অনাচার বা বাউল-ফকির বলা হয়।
বাউল-ফকিরদের শতাধিক পরিবারের মধ্যে সমীক্ষা করেছেন তিনি। যার মধ্যে থেকে বিভিন্ন সম্প্রদায় পাওয়া গেছে যেমন, সাধুমত, ইসলাম, বৈষ্ণব, আত্মতত্ব, দরবেশ, নকশাবন্দী ইত্যাদি পাওয়া যায়। সমীক্ষায় যতগুলি পরিবারকে সামিল করা হয় তার বিন্যাস নিম্নরূপ-
বাউল-১৫৫টি পরিবার, ফকির-১৫৬টি, দরবেশ-১৪২টি, মারফতি-১৬০টি, মানুস-১৫৭টি, বৈষ্ণব-৮৩টি পরিবার।
দেবতা এবং ব্যক্তিকে(পয়গম্বর বা অবতার বলা হয় যাদের)মেনে চলার নিরিখে পরিবার পিছু হিসাব হল-
মুহম্মদ-২০২টি পরিবার, চৈতন্যদেব-১৮২টি পরিবার, আলি-২০০টি, ফতেমা-১৮৮টি, রাধা-১৮০টি, কালি-১৮২টি, শিব-১৭৯টি, কৃষ্ণ-১৭৮টি পরিবার।
হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে কেও মুহম্মদকে কেও কৃষ্ণকে বন্দনা করে। সকল শিষ্যরা একসাথে থাকে, খায়, কারণ ক্রিয়া করে। মুসলমান গুরুভাইদের বাড়িতে বা ব্রাত্য সমাজের গুরুভাইদের বাড়িতে খাদ্যগ্রহণ করে। বৈষ্ণবদের একাংশ- দাসমুচি, যুগিরা গোঁসাই ও কর্তাভজা সম্প্রদায় মুসলমান সাধক গৃহে এবং সাধু সেবায় অন্নগ্রহণ করে। জাত ধর্মের বিচার বাউলদের মধ্যে নেই। আখড়া, মেলায় তাদের সহজিয়া জীবনযাপন, মুসলিম পরিবারে জন্মেও নমাজ না পড়া বা হিন্দু পরিবারে জন্মেও মুসলমানের সাথে বসবাস, একে অপরের উচ্ছিষ্ট খাওয়া-খাপ্পা করেছে দুই ধর্মের রক্ষণশীল অংশকে। এই অংশ ক্ষমতাবান, সব যুগেই এদের ক্ষমতার মন্ত্রীসভায় অবাধ যাতায়াত। তাই রাঢ় বাংলা দেখেছে আখড়া পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা।
বাউলরা বলে নমাজ দৈহিক কসরত মাত্র। কাবাশরীফের কালো পাথরের সাথে তুলনা করে কামরূপের পাথরের। যোনি সেজদার অভিযোগে (আসলে অজুহাতে) বাউল ধ্বংসের ফতোয়া দেওয়া হোত মুর্শিদাবাদে।

তথ্য-৩
হুগলী জেলার পান্ডুয়া, এক ঐতিহাসিক স্থান, আমরা জানি। এখানে জি টি রোডের পাশে হজরত শাহ সুফি সুলতানের মাজার। ২০০৯ সালে তথ্যায়নের উদ্দেশ্যে এখানে যাওয়া। সামনেই মেলা মাঠ, ফি বছর ১লা মাঘ থেকে প্রায় এক মাস এখানে মেলা হয়। মেলায় আগত মানুষজনের দান জমা হয় একটি 'দানবাক্স' তে। মাজারের দায়িত্বপ্রাপ্ত দুই খাদেম পরিবার এই দান পেয়ে থাকেন। কয়েক শতাব্দী প্রাচীন এই মাজারে সাম্প্রতিক দশকে একটি মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মিত হয়। জমিয়ত উলেমায়ে হিন্দ অনুমোদিত এই খারিজী মাদ্রাসাটি মাজারের জমিতেই নির্মিত, এক প্রকার জোর করেই।
শুরু হয় মসজিদ-মাজার বিরোধ। মাজারটি মারফতি, তাকে শরিয়তি করার প্রচেষ্টা চলছে কয়েক দশক ধরেই। বর্তমানে তা প্রবল। এক্ষেত্রে হুগলীর ফুরফুরা শরীফের মদত রয়েছে। সারা বাংলা জুড়েই বিভিন্ন মাজার, দরগা, নজরগা, উরুস মেলাগুলিকে মারফতি থেকে শরিয়তি করার প্রকল্পে শামিল ফুরফুরা। পান্ডুয়া প্রতিরোধ করেছে। এলাকাটিতে মিশ্র জনবিন্যাস, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে মাজারকে ঘিরে আগ্রহ, হজরত শাহ কে ঘিরে মিথ ও অবিমিশ্র ভক্তি প্রতিরোধকে করেছে মজবুত। মাজারের খাদেম লাল মুহম্মদের কথায়, একবার বাধা দিয়ে দেখুক না, মানুষ তা মানবে না। বিহারীরা তো কিছুতেই না।
বাধা অবশ্য প্রতিনিয়ত আসছে পার্শ্ববর্তী মসজিদ থেকে। মসজিদের ইমাম আব্দুল রউফ, বর্ধমানের মানুষ। মাজারে ধুপকাঠি জ্বালানো হয়, নকুলদানা দেওয়া হয়। কবরে চাদর চড়ানো হয়। মুসলিমরা মাজারে এসে প্রণামের ভঙ্গি করে। ইমামের ফতোয়া- এসব চলবে না। মাজারে এসে মাথা নিচু করা 'শিরক'। পীরের কবরে ধুপ জ্বালানো, চাদর চড়ানো মানে কবর পূজা করা। এসব ইসলাম বিরোধী, পৌত্তলিক। এসবের স্থান নেই ইসলামে। ইমামের ফতোয়াতে মহিলাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়েছে মাজারের ভিতরে কবরের পাশে। তারা দূর থেকে প্রণাম বা কদমবুসি করে যায়।

তথ্য-৪
২০১০ এবং ২০১৪, 'আমরা, এক সচেতন প্রয়াস' (একটি সামাজিক, আর্থসামাজিক ও সমাজ-সাংস্কৃতিক বিষয়ক তথ্যায়ন, প্রকাশনা ও তথ্যচিত্র গোষ্ঠী)এর পক্ষ থেকে মুর্শিদাবাদ জেলার ডোমকল মহকুমায় দাসেরচকে যাওয়া হয়। জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রতি মঙ্গলবার এখানে মেলা বসে, গ্রাম্য মেলা, কাকভোরে শুরু হয়ে সন্ধ্যায় শেষ। ডোমকল, জলঙ্গি, রানীনগর সহ বহু দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসেন এখানে, এই মেলায়। কোন মন্দির বা মাজার বা থান নেই এখানে, নেই জেলাজুড়ে প্রসিদ্ধি। আছে শুধু বুড়ো বট। জলঙ্গির এক কাঁদর রয়েছে, পাশে এই বনস্পতি।
ইতিহাস বলছে, রামানুজ সম্প্রদায়ের যোগীপুরুষ মস্তরাম বঙ্গাব্দের ১০৬০সালে বর্তমান উত্তরপ্রদেশের কৌনজে জন্মে ছিলেন।মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জের উত্তরে সাদেকবাগে তাঁর আখড়া ছিল। সাদেকবাগ অনেকের কাছে সাধকবাগ। এছারা দাসেরচকেও কিছুকাল বসবাস করেন মস্তরাম। সেখানে নানারকম যৌগিক ক্রিয়া-কর্ম দেখাতেন তিনি। এমনই ছিল সাধারণের বিশ্বাস। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে মনোমালিন্য কমাতে সচেষ্ট ছিলেন তিনি। ধর্ম নির্বিশেষে সকলের সঙ্গে অবস্থান এবং সহজ জীবন যাপন জনপ্রিয় করেছিল তাঁকে।
লোকমুখে তাঁর জনপ্রিয়তার কথা শুনে ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ। মস্তরামের পরীক্ষা নেন তিনি। 'অলৌকিক' কিছু কাণ্ড ঘটিয়ে নবাবকে তৃপ্ত করেন সাধক। সম্মোহিত মুর্শিদকুলি তাঁকে সাচ্চা পীর বলে স্বীকার করেন। তাঁকে গোলাপবাগ দান করেন। শ্রদ্ধাবশত 'আউলিয়া' উপাধি দেন তাকে। বাদশাহী সনদে মস্তরামের নাম লেখা হয়, 'হজরত মস্তরাম আউলিয়া আসাদউল্লা এহেতেসাম-উল-মুলুক'।
এহেন মস্তরাম দাসেরচকের মস্তরাম কিনা সে নিয়ে বিতর্ক আছে। থাক সেসব। আমাদের আহরণ প্রকল্প এখানের মেলার বৈশিষ্ট্য নিয়ে। মেলা কমিটিতে হিন্দু- মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মানুষ আছেন, জনসমাগমেও তাই। মস্তরামের ঐতিহ্য মানলে সেটাই স্বাভাবিক। অবাক করা বিষয় হল বট গাছের নিচে একসাথে বাউল, ফকির, দরবেশ, সুফি, শৈব, বৈষ্ণব, শাক্ত, তান্ত্রিকের সমাবেশ। সকলেই নিজের আরাধ্য দেবদেবী বা অবতার বা প্রতীক বা কলমা শাহাদাৎ লেখা ছবি নিয়ে গাছের নিচে আসীন। সকাল হতে মেলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত মানুষের ভিড়। শৈব সাধকটির কাছেই হয়ত জাহানারা বেওয়া, সন্তানের আরোগ্য কামনায়। অদূরে মনসুর ফকির তখন গান ধরেছেন, 'যেমন কৃষ্ণ খেলা করে মা যশোদার কোলে, তেমন সেথায় নবী আমার দোলে মা আমিনার কোলে।' পাশেই কালো আলখাল্লা পড়া দরবেশ মাথায় হাত রেখে মঙ্গল কামনায় রত। অবনতশীরে পার্শ্ববর্তী গ্রামের দত্ত পরিবার। ঘণ্টা নাড়িয়ে কালি সাধনায় ব্যাস্ত যখন একজন অপরজন তখন নমাজে। জায়নমাজ কখন যে কম্বলের আসন হয়ে গেছে খেয়াল নেই কারো।
বনস্পতির কাছেই একটি ছোট্ট পুকুর। জমির প্রথম ফসল যেমন বেগুন, কফি, বাগানের প্রথম ফল যেমন কাঁঠাল, নারকোল, গাভীর প্রথম দোয়ানো দুধ ঢালা হয় এখানে। অনেকে মুরগীর ডিম ফুটে বেড় হওয়া প্রথম শাবক এনেছে, পুকুরের জলে একবার ডুব দেওয়াতে। টুকরো টুকরো ছবি, অসাধারণত্ব কিই বা আছে? আর পাঁচটা গ্রাম্য মেলা থেকে কোথায় এর অনন্যতা? কিভাবে লড়ছে অস্তিত্বের লড়াই? দেখা যাক।
ডোমকল মহকুমার কয়েকজন ইমামের সাথে কথা বলেছিলাম আমরা। কেও ক্যমেরার সামনে মস্তরামের মেলা বা সেখানে সাধারণ মুসলিম জনতার অংশগ্রহণ নিয়ে কিছু বলতে চাননি। মেলা থেকে ফেরার পথে বর্তনাবাদ জামা মসজিদের ইমামের সাথে কথা হয়।সজ্জন ব্যক্তি। তিনি কম বলেন, তাঁর হয়ে পারতপক্ষে বলে দেন পার্শ্ববর্তী গ্রামের এক ইমাম। বয়সে যুবা, নিয়মিত ... শোনেন। বললেন, শুধু মস্তরাম কেন বাউল ফকিরের গান, উরুস মেলা, মাজার, কবরে চাদর চড়ানো এমনকি মহরম পর্যন্ত শরীয়ত সম্মত নয়। আমরা স্পষ্ট ভাবে এলাকার মানুষদের বলেছি, মস্তরামের মেলা ইসলাম সম্মত নয়।
তবু যে বহু মানুষ (এখানে মুসলমান) যায়?
যায়, তবে আমাদের এদিক থেকে কমে এসেছে।
কোনও ফতোয়া?
ফতোয়া বলেন বলতে পারেন, কিন্তু শরীয়ত বিরোধী কোন কিছু বরদাস্ত করা ওয়াজিব নয়। আমরা তাই করছি।
আমরা মানে?
এখানের শতাধিক মসজিদের ইমাম এবং ঈমানে আস্থা রাখা মজলুম জনতা।
বাস্তবতা হল, চার বছরের ব্যাবধানেই আমরা প্রত্যক্ষ করলাম, মেলায় মুসলিম জনতার অংশগ্রহণে আনুপাতিক হ্রাস। মারফতি ও বৈষ্ণব ঘরানার মিশ্রণ ক্রমে হিন্দুয়ানী হয়ে উঠছে। কালির একটা মন্দির হয়েছে মেলার পরিসরেই। সেখানে প্রবেশে অবশ্য কারো বাধা নেই। মেলায় সাধক-সাধিকারা বাতাসা,মুড়কী,সিন্নি,হালুয়া বিতরণ করতেন। মেলায় জিলিপি-তেলেভাজা মত রমরমিয়ে না হলেও বিক্রি হত গরম রুটি আর মুরগীর মাংস সেই ভরা জ্যৈষ্ঠের দুপুরেও। এবারে 'হরির লুঠ' (প্রকারন্তরে বাতাসা বৃষ্টি) হয়েছে অনেক বেশী। সিন্নি, হালুয়া, রুটি-মাংস যেন সরে এসেছে কাতার থেকে।

তথ্য-৫
মস্তরামের জনপ্রিয়তা একান্তভাবে স্থানীয়। সারা বাংলায় হিন্দু- মুসলমান নির্বিশেষে জনপ্রিয়তম পীর হলেন, সত্যপীর। হিন্দু বাঙালীরা গ্রামে এমনকি শহরের ফ্ল্যাটের নিভৃতেও সত্যপীরের বা সত্যনারায়ণের পুজো করে, পাঁচালি পড়ে। সত্যপীরের নামে দরগা অবশ্য খুব কমই দেখা যায়। উত্তর ২৪ পরগণার বারাসাত মহুকুমার অধীনে কালসারা গ্রামে একটি দরগার কথা জানা যায়। ফয়জুল্লা রচিত সত্যপীরের পুঁথিতে এবং 'বেঙ্গল সেটেলমেন্ট রেকর্ড, ১৯২৮-৩১'-এ উক্ত দরাগাটির উল্লেখ আছে। এই দরগাটি প্রায় তিন বিঘা জমির ওপর অবস্থিত। সেবায়েতদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের আমলে প্রায় ষোল বিঘা জমি সত্যপীরের নামে দান করা হয়। দক্ষিণ ২৪ পরগণার বজবজ থানার একটি গ্রাম হল বাওয়ালী। এখানেও সত্যপীরের নামে একটি থান আছে। দুটি স্থানেই ভক্ত সমাগমে ধর্ম প্রাচীর হতে পারেনি। কালসারাতে সত্যপীরের দরগাতে সকলে রোগমুক্তি ও সংসারের মঙ্গল কামনায় শিরনি/সিন্নি দেয়, মানত করে। দরগাতে প্রতিদিন ধুপবাতি জ্বালানো হয়, দেওয়া হয় ফুল, ফুলের মালা, বাতাসা ুঠ দেওয়া হয়। ফি বছর ১৬ ফাল্গুন মেলা বসে এখানে। আগে কাওয়ালি গানের আসর বসত। এখন বসেনা।
কিছু ইতিহাসবেত্তার মত হল, বাগদাদের সুফিসাধক মনসুর আল হাল্লাজ হলেন মূল সত্যপীর। মরমীয়া এই সন্তকবি 'আমিই সত্য' বা 'আন অল হক' ঘোষণা করেন। এই ঘোষণা শরীয়ত বিরোধী। শাস্তি হয় আট বছর কারাবাস। কারাগারে অকথ্য নির্যাতন চলে হাল্লাজের ওপর। তবু বন্ধ হয়নি তার মুখ, দার্শনিক তত্ত্ব কথা। ক্ষুব্ধ শাসক ও উলেমাকুল তাঁকে শূলে চড়ানোর আদেশ দেয়। অন্তিম সময়েও হাল্লাজ উদাত্ত স্বরে বলে ওঠেন, ''আন অল হক'।
"Now stands no more between truth and me
Or reasoned demonstration
Or proof of revelation"
তবে বিতর্ক একটা আছেই, উনি কি হিন্দুর দেবতা নাকি মুসলমানের পীর তা নিয়ে। স্কন্ধ পুরাণের রেবাখন্ডে সত্যনারায়ণ পূজার ভিত্তিমূল আছে। উপনিষদের 'অহম ব্রহ্মাস্মি'(আমিই ব্রহ্ম) এবং 'আন অল হক'-এই কথাদুটির একই অর্থ। আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ বলেছেন, হতে পারে সত্য নামধারী কোনও দেবতাকে হিন্দুরা নারায়ণ শব্দ যোগ করে এবং মুসলিমরা পীর শব্দ যোগ করে আপন করে নিয়েছেন। যদিও সত্যনারায়ণে ও সত্যপীরে যে কোন ভিন্নতা নেই, তিনি বলেছেন সেকথাও।
"হিন্দুর দেবতা আমি মোমিনের পীর
যে যাহা কামনা করে তাহারা হাসিল"
'সত্য' আরবি শব্দ 'হক'-এর প্রতিরূপ। সুফি সন্তরা ঈশ্বরকে এই নামে সম্বোধন করতেন। সপ্তদশ শতকের শেষ দুই দশকে পীর ও নারায়ণের একাত্ম মূর্তি পশ্চিম ও উত্তর বঙ্গে নতুন লোকদেবতা রূপে চর্চায় এবং চর্যায় উঠে আসে। রচিত হয় শতাধিক পাঁচালিকাব্য। কাব্যকথাগুলি ঘরে ঘরে পাঠিত হতে থাকে ভক্তি ও সমর্পণের আবেশে। রাঢ় বাংলায় আজও যে পাঁচালিটি পাঠ করা হয় সেটির রচয়িতা হলেন ফয়জুল্লা। দক্ষিণ রাঢ়ের বাসিন্দা ফয়জুল্লার কাব্যের কাহিনীর সাথে রামেশ্বর ভট্টাচার্যের রচনার মিল আছে।
"সেলাম করিব আগে পীর নিরঞ্জন
মহম্মদ মুস্তফা বন্দো আর পঞ্জাতন
যমুনার তটে বন্দো রাস বৃন্দাবন
কৃষ্ণ বলরাম বন্দো শ্রীনন্দের নন্দন"
বাস্তবতা হল, বাঙালি হিন্দুর 'তেত্রিশ কোটি'-র সাথে আরও একটি যুক্ত হলে বৈচিত্র্য আসে বিপন্নতা নয়। কিন্তু একেশ্বরমুখী ইসলামে সত্যপীরের অবস্থান 'বিপন্নতা' আনে, কোরান হাদিস কেন্দ্রিক মৌল নীতিমালাকেই বাস্তবে চ্যালেঞ্জ জানায়। বাঙালি মুসলমান সত্যপীর থেকে দূরত্ব বাড়িয়েছে, মসজিদের সর্বগ্রাসী প্রভাব যবে থেকে চিরায়ত বাংলার লোকায়ত ইসলামকে করেছে কব্জা।

(২)
শরিয়তি ইসলাম ও সুফিবাদ-
মৌল ইসলাম থেকে সুফিবাদের জন্ম হলেও শরিয়ত ও সুফি মতবাদের মধ্যে পর্যাপ্ত পার্থক্য আছে। সুফিবাদকে লৌকিক ইসলামের কিছু ক্ষেত্রে আকর বলা যেতে পারে। আমরা জানি, চৈতন্যের মৃত্যুর পরে বৈষ্ণব ধর্মের কিছু অংশ মননশীল শাস্ত্রচর্চাকে গুরুত্ব দিতে থাকে, ফলে সাধারণ মানুষ হতে ক্রমে দূরে চলে যেতে যেতে ব্রাহ্মন্যবাদের করাল গ্রাসে গ্রাসিত হয়। সুফিবাদেও তেমনই শরিয়ত প্রভাব বাড়তে থাকে। মারফতিকে শরিয়তি করার, সুফি সঙ্গীত স্তব্ধ করার, মসজিদমুখী সমাজ বানানোর প্রকল্পগুলির খণ্ডচ ত্র পাওয়া গেল উপরিউক্ত তথ্যগুলি থেকে। এও জানলাম যশোদা-কৃষ্ণের চিরকালীন মাতা-পুত্রের খুনসুটি আর পুত্রের দুরন্তপনা সুফি পন্থ বা তসাউফে এবং লৌকিক ইসলামে কোন আপত্তি নেই, নেই বিপন্নতার জিগির। শরিয়ত বা মৌল ইসলাম ও সুফি মতবাদের মধ্যে মতপার্থক্যগুলি এইরকম-
১। শরিয়ত ইসলাম বাহ্য আচরণ নির্ভর। সুফিরা অন্তরের শুদ্ধির ওপর বেশী জোর দেয়।
২। শরিয়ত অন্ধ আনুগত্য, ঈশ্বরের প্রতি ভয় করতে শেখায়। সুফিবাদ 'ঈশ্বরের কাছে পৌঁছনর জন্য প্রেমই হল একমাত্র উপায়'-একথা বলে।
৩। সুফিবাদ রহস্যবাদী প্রবৃত্তি, হাল(ভাবাবস্থা) সন্ন্যাসজীবন,একান্ত বাস ইত্যাদিকে গুরুত্ব দেয়, মৌল ইসলাম তা দেয় না।
৪। শরিয়ত সম্পূর্ণ কোরান-হাদিস নির্ভর। কোরান, হাদিস নিয়ে মতভেদ ও বিতর্ক প্রচুর (এখানে তা নিয়ে আলোচনার অবকাশ নেই)। কোরানে উল্লিখিত মক্কী সূরা কিছুটা উদার, কিন্তু মদনী সূরা অনুদার এবং প্রতিহিংসাকে আহ্বান করে। মৌল ইসলাম অন্য ধর্মের প্রতি অনুদার। সুফিবাদ উদার, সহাবস্থান ও সংশ্লেষে আপত্তি নেই। সুফিরা 'জেহাদ'-এর অর্থ হিসাবে ধর্মযুদ্ধ বা বিধর্মী হত্যার প্রচলিত ধারা ত্যাগ করে। তাদের কাছে জেহাদ হল হৃদয়ের কুচিন্তা, কুইচ্ছার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। অর্থাৎ বড় জেহাদে আস্থা। মৌলমতের আস্থা ছোট জেহাদে।
৫। সুফিমতে গুরু-শিষ্য বা পীর-মুরিদ পরম্পরাকে স্বীকার করা হয়। শরিয়ত নির্ভর ইসলাম তাকে মান্যতা দেয় না, বলে এসব ইসলাম বিরোধী।
৬। পরমাত্বার স্বরূপ কি, এই নিয়েও মতভেদ প্রচুর। সনাতনপন্থীরা মান্য করে ঈশ্বরের সর্বাতীত অসীম রূপকে। তারা কখনও মনে করে না আত্মা পরমাত্মাতে লীন হতে পারে। এ ভাবনা তাদের কাছে ঈশ্বরকে হেয় করা, তার অসীমত্বকে অস্বীকার করার সমতুল। কিন্তু তসাউফ তথা সুফিমতে মানুষ ঈশ্বরের দাস নয়, প্রেমী। দুইয়ের মধ্যে রাগাত্মক সম্বন্ধ সুফিবিচারের বিশিষ্টতা। তারা তাই ঈশ্বরের সাথে 'ফনা' (বিলীন) বা নির্মাণ হবার কথা বলে।
৭। মৌল ইসলামে ঈশ্বর নিরাকার, কোন প্রতীকই তার কাছে গ্রহণীয় নয়। সুফিবাদ ঈশ্বরের নিরাকার তত্ত্বে বিশ্বাসী হলেও পীরের দরগায় চাদর চড়ানো, ইটবাঁধা ইত্যাদি অসংখ্য প্রতীক ও প্রথায় আস্থা রাখে।
৮। সুফিমতের বিভিন্ন পন্থে সঙ্গীত, নৃত্য, চিত্র আঁকা শুধু প্রচলিতই নয়, বরং ঈশ্বরের কাছে পৌঁছনর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হিসাবে গৃহীত। আজমীর শরীফে চিস্তি সম্প্রদায়ের নৃত্য, বাউল-ফকিরি গান, নক্সাবন্দী থেকে পটুয়া পর্যন্ত নক্সা ও পট আঁকা- এসবের প্রাণময়তা চ্যালেঞ্জ জানায় শরিয়তকেই। শরিয়তে এসব কিছুই নিষিদ্ধ।

(৩)
সংঘাত ও কথিত সৌহার্দ (বশ্যতা)-এর একাধিক ঘটনা ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত, আমাদের জানার বাইরে। এর অল্প কিছুরই তথ্যায়ন করা শুরু হয়েছে। উঠে এসেছে শত বাধা সত্ত্বেও লৌকিক ইসলামের বেঁচে থাকার এবং কোন কোন ক্ষেত্রে প্রতিরোধ করার চিত্র। এই অনুপ্রয়াসে হয়ত ভাঙা যাবে ইসলাম সমন্ধে গড়ে ওঠা কিছু মিথ।
ইসলামকে বুঝতে গেলে তার বিবিধতা, লোকজ নিজস্বতা বুঝতে হয়। ইসলামকে একমুখী, বর্ণহীন, গন্ধহীন, তথা জীবনহীন এক 'জোর জবরদস্তি' করার প্রকল্পে সবথেকে আগে শরিয়তপন্থীরা। সারা বিশ্বে এবং এই বাংলায় বেশ কিছু বুদ্ধিজীবীও শামিল এই উদ্যোগে। শরিয়তপন্থীদের সাথে সুরে সুর মিলিয়ে এরা বলেন, আজমির শরীফে খাজা মইনুদ্দিন চিস্তির দরগায় চাদর চড়ানো বা দিল্লীর নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগায় সুফি সঙ্গীত এবং গোলাপের ডালা নিবেদন ইসলাম নয়। মৌলবি মৌলনাদের অবস্থান বুঝতে অসুবিধা হয়না, কেননা তাদের শরিয়ত-নির্ভরতা এবং কোরানের প্রতি আস্থা কোন কোন ক্ষেত্রে প্রশ্নাতীত। কোরানের সম্পূর্ণ অনুসরণ লৌকিক অনুষঙ্গ পরিহার করতে বলে। 'কোরানে ফিরে যাও' বা 'Back to the Koran' যুগে যুগে ফিরে এসেছে তাজদিদ (পুনর্নবীকরণ) এবং ইসলাহ (সংস্কার)প্রক্রিয়া হয়ে। এবং 'ইসলাম বিপন্ন'- এই স্লোগান কি ধর্মীয়, কি সামাজিক, কি রাজনৈতিক ইসলামে বজায় রয়েছে আদি থেকে বর্তমানে।
এর বিপরীতে কেস স্টাডি হিসাবে বাংলার লৌকিক ইসলামের কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন, কেননা তাদের অস্তিত্বই বাস্তবের শরিয়ত বিরোধিতা। বিশদে নয়, সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক বাংলার প্রেক্ষিত।
আমরা জানি প্রচারমুখী বেশীরভাগ ধর্মই নতুন দেশে নতুন পরিবেশে গিয়ে তার আদিরূপের আমূল পরিবর্তন না করেও বহিরঙ্গে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয়েছে, যা এক নতুন ঘরানা বা রূপ লাভ করে। হিন্দু ধর্ম যখন যাভা সুমাত্রা মালয় দেশে যায় তখন সেখানের স্থানিকতাকে আশ্রয় করে। সেখানে এমন এক অবয়ব লাভ করে যা সেখানের নিজস্ব। বলিদ্বীপের নারায়ণ, রাম, সীতা, লক্ষ্মী, রাধা, কৃষ্ণ ইত্যদির মূর্তিগুলি দেখতেও সেই দেশের মানুষের মতো। যেমন তিব্বত হতে জাপান সর্বত্র অবলোকিতেশ্বরের মূর্তি তার আদিদেশ ভারতবর্ষের মতো নয়, বরং স্থানীয় মানুষের মুখাবয়ব। মঙ্গলয়েড ফেস। ইসলামে বিগ্রহের স্থান নেই, থাকলে আলজেরিয়া, সোমালিয়ার মুহম্মদ মূর্তি হয়ত কৃষ্ণবর্ণের হতো। প্রচারমূলক ধর্মগুলির নতুন দেশে স্থানিক রূপগুলিকেই লৌকিক বলা হয়। ইসলামের লৌকিক রূপ ভারতবর্ষের বিশেষত্ব। যা শুরু থেকেই বেদায়ৎ বলে অভিহিত। যদি তা আল্লাহর তৌহিদ অর্থাৎ ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয় এই মতবাদের বিরুদ্ধে হয় তবে তাকে অবশ্যই শিরক বলা হয়। নতুন দেশের নতুন ধর্ম-সাংস্কৃতিক পরিবেশে গড়ে ওঠা এই বেদায়ৎগুলির সঙ্গে ইসলামের আদিরূপের বা শরিয়তের কোন মিল নেই, সম্পর্ক তো বহুদূর। নব-মুসলিমদের আচার, রীতি-নীতি, ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক-সামাজিক অনুষ্ঠানে ভিন্নতা স্পষ্ট। মৌল ইসলামের আচার অনুষ্ঠানের শিরকগুলি লোকজ বিশ্বাসের ও প্রথার সাথে বেশী সংশ্লিষ্ট।
আদিভুমি আরব থেকে ইসলাম পারস্যে গেছে। সেখানে গিয়ে সেখানের লৌকিক রূপ আয়ত্ত করেছে। বিভিন্ন দেশে, জনপদে, কৌমে তার রূপ বিভিন্ন হয়েছে। তাই বাংলার বা ভারতের লৌকিক ইসলাম আর পারস্যের বা মালয় উপদ্বীপের লৌকিক ইসলামে ভিন্নতা আছে। তবে এখানে পারস্যের লৌকিক প্রভাব দেখা যায়। কারণটা ঐতিহাসিক। এদেশে পারসিক সংস্কৃতির মাধ্যমেই সুফি মধ্যস্থতায় তুর্কি-পাঠান-মুঘলদের দ্বারা ইসলাম প্রচারিত ও প্রসারিত হয়। তাই-ই পিরবাদ। প্রাচীন ভারতে গুরু-শিষ্য পরম্পরার গ্রহণযোগ্যতা ছিলই, তাই পির-মুরিদ সিলসিলার এত জনপ্রিয়তা।
শরিয়তের বিপরীত অবস্থানে লৌকিক ইসলামের জনপ্রিয় ধারায় পিরবাদ এক বলিষ্ঠ ধর্মবিশ্বাস। লোকায়ত ধারা। তাই মৌল ধর্মের আচারসর্বস্বতা এখানে নেই। বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিব মুসলমান এখনও এই মতবাদে বিশ্বাসী। এর অসম্ভব রকমের প্রাণময়তা, সহজ যাপন বোধ এবং জনপ্রিয়তা এখনও শরিয়তপন্থী যাবতীয় প্রাবাল্য, ওয়াহাবি আন্দোলন আদি তাবড় শক্তিকে রেখেছে ঠেকিয়ে। বৈজয়ন্তী এই ব্রাত্যজনের যোধন।
ঐতিহাসিক মহম্মদ এনামুল হকের মতে বঙ্গে লৌকিক ইসলামের জনপ্রিয়তার একাধিক কারণ রয়েছে। যারা সদ্য ইসলাম কবুল করেছিলেন তাঁদের পক্ষে বংশপরম্পরায় প্রাপ্ত ও লালিত আচরণ পাল্টানো সহজ ছিল না। সময় পেরিয়েছে, দশক, শতাব্দী। তার বিভিন্নতা নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ এসেছে লোকজ ইসলামের শাখা প্রশাখায়। প্রধানত সুফি সংসর্গে এই বঙ্গে ইসলাম প্রসারিত হয় পারসিক, তাজিক, মোঙ্গল, আফগান, তুর্কি ইত্যাদি আদি বৌদ্ধজাতির আগমনে। পূর্ববঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচলন ছিলই। ফলে বহুস্থানিক বৌদ্ধ উপসর্গের সংশ্লেষ। প্রসঙ্গত বলা যায়, এই বৌদ্ধজাতিরা ১১ ও ১২ শতকে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। তাদের আজন্ম প্রথাকে তারা বর্জন করেনি।
ফারসি 'পির' শব্দ মূলত বৌদ্ধদের 'থের'(অর্থাৎ সংস্কৃতে স্থবির)শব্দ থেকে এসেছে। প্রাচ্য বৌদ্ধদের চৈত্যপূজা নব্য মুসলমানদের 'পিরপুজা', 'গোরপূজা'র আদিরূপ। প্রাচীন বৌদ্ধদের মধ্যে থের সমাধিকে ঘিরে কিছু আচার ছিল, যেমন ধূপধুনো জ্বালানো, চন্দন মাখানো, পুস্পাঞ্জলি দেওয়া ইত্যাদি। মজার কথা হল, এইগুলিরই রূপান্তর আমরা দেখি পিরের কবরে লোবান জ্বালানো, গোলাপ জল ছিটানো, আতর মাখানো ইত্যাদির মধ্যে। মৌল মতে এসব অন-ইসলামীয়। যদিও আতর, লোবান, গোলাপ মুসলমানদের মধ্যে বহুল ব্যবহৃত।
বাস্তবতা হল বাংলায় মাজার, দরগা, নজরগা, উরস মেলা, লোককাহিনী ঘিরে শরিয়তি ও মারফতি এই দুই ধারার সন্নিবেশ। সংঘাতে, সহবস্থানে। বীরভূমের সিউড়ির অনতিদূরে পাথরচাপরিতে দাতা বাবার মাজার। আমার আশৈশব স্মৃতি এই মাজার ঘিরে। উরস মেলায় বাউল ফকির সামিল হয়। মারফতি চালু এখানে। মুর্শিদাবাদের ইসলামপুর থেকে এসেছেন টুকরো টুকরো কাপড়ের সন্নিবেশে আংরাখা বা আলখাল্লার মোড়কে এক বিবাগি ফকির। মন্সুর ফকির। মধ্যবেলায় গলায় তখন লালন সাঁই, প্রতিস্পর্ধায়, প্রাণোদনায় -
'সহজ মানুষ ভজে দেখনা রে মন দিব্য জ্ঞানে
পাবি রে অমূল্য রতন বর্তমানে
ভজো মানুষের চরণ দুটি
নিত্যবস্তু হবে খাঁটি
মরিলে সবই মাটি
তোরা এই ভেদ লও জেনে
শুনি মরলে পাবো বেহেশত-খানা
তা শুনে তো মন মানে না
বাকির লোভে নগদ পাওনা
কে ছাড়ে এই ভুবনে
সালাতুল মেরাজুন মমেনিনা
জানতে হয় নামাজের বেনা
বিশ্বাসীদের দেখা-শুনা
লালন কয় এই ভুবনে'

অদূরে মেলার দক্ষিণ প্রান্তে, মাধব বাউল যখন গলা তোলেন, দুচোখ জুড়ে তখন ময়ূরাক্ষী, বাঁধভাঙ্গা।
'নবি মোর পরশ মনি।
নবি মোর সোনার খনি
নবি নাম জপে যে জন সেইতো ধনী।...
ঐ নামে সুর ধরিয়া
পাখি যায় গান করিয়া
ঐ নামে আকুল হইয়া ফুল ফোটে সোনার বরণী'
খবরে প্রকাশ, বিগত কয়েক বছর পাথর চাপড়ির মেলায় তৌহিদপন্থীদের মিছিল হয়েছে, দাবী করা হয়েছে, এসব বরদাস্ত করা হবে না। আশঙ্কা, অদূরেই মেলাটি তার মারফতি চরিত্র হারাবে।

আশঙ্কা আছে, আছে আশাও। আছে বাংলা তথা উপদ্বীপের প্রান্তে ও প্রান্তরে বিতত সংখ্যাতীত মাজার দরগা মেলাকে ঘিরে হিন্দু-মুসলমান-শিখ-খ্রিস্টানদের যাপন ও যোধন কথা। টুকরো থেকে সমগ্র হয়ে ওঠা লৌকিক ইসলামের পরিলেখ। পরিশেষে একটি ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ করে এই রচনার ইতি টানছি। যা বাবরি মসজিদ ধ্বংসোত্তর জঙ্গি-হিন্দুত্ব এবং জেহাদি ইসলামে বিভক্ত আজকের ভারতবর্ষে অভাবিত বলে মনে হবে।
পানিপথ, দিল্লীর কাছে একটি ছোট্ট শহর। প্রায় দু'শতক আগের কথা। এক মুসলিম বিদ্বান ব্যক্তি এখানের এক হিন্দু মহল্লায় থাকতে শুরু করেন। কিন্তু বিপদ না বলেই আসে। সন্তান প্রসবকালে তাঁর স্ত্রী অকস্মাৎ মারা যান। যদিও সদ্যোজাতটি সুস্থ থাকে। অকুল পাথারে পড়েন মৌলবি সাহেব। তাঁর পক্ষে দ্বিতীয় বিবাহ করা সম্ভব ছিল না। সম্ভব ছিল না অন্যত্র চলে যাওয়া। কিন্তু হটাৎ ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিল। প্রতিবেশী এক ব্রাহ্মণ রমণী এগিয়ে এলেন। এক সদ্যোজাত কন্যাসন্তান আছে তাঁর। তারপর রচিত হল ইতিহাস। ব্রাহ্মন সমাজ ও ধর্মের নিয়ামকদের আপত্তি অগ্রাহ্য করে দুটি সন্তানকে বড় করত থাকলেন তিনি। মাতৃস্নেহে ও মাতৃদুগ্ধে। এভাবেই প্রখ্যাত সুফি সাধক হজরত ঘাউস আলি শাহ কলান্দর পানিপথী এক হিন্দু পণ্ডিতের ঘরে বড় হলেন। পণ্ডিতজীর কাছে সংস্কৃত এবং মৌলবি সাহেবের কাছে আরবি-ফারসি সহ অল্প বয়সেই সনাতন ও ইসলাম ধর্মে হয়ে উঠলেন পারদর্শী। ঐতিহাসিকদের লেখায় এবং স্থানীয় লোকবিশ্বাসে অবশ্য মতপার্থক্য আছে। পণ্ডিতজীর কোন পুত্র সন্তান ছিল না। জানা যায়, ঘাউস আলি শাহ যখন সদ্য যুবা, মারা যান ব্রাহ্মণ পত্নী। মায়ের প্রয়াণে বিপর্যস্ত, শোকাহত ঘাউস আলি বিস্মৃত হন না পুত্র কর্তব্য থেকে। উলেমাকুল আর পুরোহিতবর্গ চরম বিরোধিতা করে। মুসলমানের ছেলে 'হিন্দু মা'-র পারলৌকিক ক্রিয়া করবে, মেনে নিতে পারে না শাসকরাও। বিরোধিতা উপেক্ষা করেন ঘাউস আলি, ঠিক যেমন তাঁর মা করেছিলেন তাঁকে কোলে তুলে নিয়ে। শত শত সাধারণ মানুষ ছিলেন 'মা-ছেলে'র চিরন্তন আবেগের সমর্থনে। নদীতীরে অশৌচান্তে মস্তকমুণ্ডন, নান্দীমুখ, শ্রাদ্ধ কর্ম করেন হজরত, দুই পারে তখন লক্ষ মানুষের সমাগম। সবশেষে উচ্চারণ করেন গায়েত্রি।
তারপর। প্রতি বছর হজরতের মাজারকে ঘিরে এখানে সেই নদীর তীরে উরস মেলা বসে। মেলা শুরু হয় গায়েত্রি মন্ত্র দিয়ে, শেষ হয় কালমা শাহাদাত দিয়ে। লৌকিক ইসলামে এসবে বাধা নেই। এই হল ভারতের নিজস্ব ইসলাম। এবং এই আমাদের ভারতবর্ষ। পাক জমিন এ হিন্দুস্তান।

গ্রন্থসূত্র-
১। Sufism
IT'S SAINTS AND SHRINES
John A. Subhan
Samuel Weiser INC, New York, 1970
২। Tadhkirat-Ul-Auliya
Nicholson
৩। Studies in Islamic Mystism
Nicholson
৪। Outlines of Islamic Culture
Sustori
৫। বাংলার পীর সাহিত্যের কথা
ডাঃ গিরীন্দ্রনাথ দাস
শেহিদ লাইব্রেরি, কলকাতা
৬। বস্তুবাদী বাউল
শক্তিনাথ ঝা
লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী কেন্দ্র, কলকাতা
৭। রচনাবলী
মুহম্মদ এনামুল হক
বাংলা একাডেমী, ঢাকা
৮। কবিবল্লভের সত্যনারায়ণের পুঁথির ভূমিকা
সম্পাদনা-মুন্সি আব্দুল করিম
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, কলকাতা
৯। সুফিবাদঃ সংশ্লেষ সংবিত্তি ও উৎসারিত আলো
শুভপ্রতিম রায়চৌধুরী
বর্তিকা, কলকাতা




Lihat lebih banyak...

Comentarios

Copyright © 2017 DATOSPDF Inc.